উপমন্যু রায়
ফল স্পষ্ট। স্পষ্ট মানে অত্যন্ত স্পষ্ট। পশ্চিমবাংলার বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপিকে এক প্রকার ধুয়েই দিয়েছে তৃণমূল।
না, ভুল বললাম। বিজেপিকে নয়, বিজেপির প্রভাবকে। যে প্রভাব গত কয়েক বছর ধরে বাংলায় বেশ বাড়িয়ে নিয়েছিল তারা। কেন না, তার আগে বাংলায় তাদের কোনও জমিই ছিল না। সেই তুলনায় এবারের নির্বাচনে তারা যে ভালো ফল করেছে, সে কথা সত্যি।
কিন্তু গত কয়েক বছরের নিরিখে যে ভাবে প্রভাব বাড়িয়েছে বিজেপি এবং যে কারণে তারা বাংলার ক্ষমতায় চলে আসবে বলে বিভিন্ন মহলের তরফে মনে করা হচ্ছিল, তা কিন্তু ভুল প্রমাণিত হয়েছে।
এখন প্রশ্ন, বাংলায় এবার এমন সাফল্য পাওয়ার কথা তৃণমূলও কি ভেবেছিল? আমার মনে হয়, না। যতই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলুন না কেন, ‘আমরাই ২০০–র বেশি পাব, বিজেপি ৮০–ও পাবে না।’ যদিও ফলটা অনেকটাই সেই রকম হয়েছে। তবু বলব, জেতার আশা করলেও এত ভালো ফল হবে, তেমন আশা বোধ হয় তৃণমূলের কেউই করেননি। দলনেত্রীও নন। তাই ফল প্রকাশের পর জানাতে দ্বিধা করেননি, তিনি এত খুশি এর আগে কখনও হননি।
সেইজন্য এ ক্ষেত্রে কিন্তু দুটো প্রশ্ন উঠবে, প্রথমত, তৃণমূল এত সাফল্য পেল কেন? দ্বিতীয়ত, বিজেপিরই বা এই ব্যর্থতার কারণ কী?
প্রথমে বিজেপির ব্যর্থতার কথাটা বলা যাক। এ কথা ঠিক, ভারতীয় রাজনীতিতে এই মুহূর্তে নরেন্দ্র মোদির মতো বড় মাপের নেতা আর নেই। শুধু তাই নয়, রাজনৈতিক নেতা হিসেবে সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে অমিত শাহরও গুরুত্ব অনেকখানি। তাই তাঁদের রাজনৈতিক আত্মবিশ্বাস থাকাটা অস্বাভাবিক কিছু নয়।
কিন্তু, এখন মনে হচ্ছে, এই আত্মবিশ্বাসটাই অতিরিক্ত হয়ে গিয়েছিল। তাই শেষ পর্যন্ত তা গেরুয়া শিবিরের ক্ষেত্রে আত্মঘাতী চেহারা নিয়েছে।
বিশেষ করে ভারতে কেন্দ্রীয় সরকারের অর্থনীতির কথা বলতে হয়। যেমন, সাম্প্রতিক সময়ে ভারতে রান্নার গ্যাস, পেট্রোল, ডিজেল এবং কেরোসিনের ক্রমাগত দাম বৃদ্ধি, এলআইসি (জীবন বিমা কর্পোরেশন) এবং রেল নিয়ে বেসরকারিকরণের কিছু সিদ্ধান্ত সাধারণ মানুষের ওপর প্রবল চাপ তৈরি করেছে।
অথচ, এ কথা ভাবতেই চাননি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। তাঁরা ভেবেছেন, তাঁদের প্রচারটাই আসল। প্রচারে তাঁদের দেখলে এবং বক্তব্য শুনলে ভিন্ন কোনও ভাবনাকে মানুষ প্রশ্রয় দেবেন না।
কিন্তু তাঁদের এই ধারণা যে ভুল, বাংলা তা এই নির্বাচনে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। এই নির্বাচনের ফল দেখে মনে হচ্ছে, বাংলার মানুষ ভোট দেওয়ার ক্ষেত্রে তাঁদের কথা ভাবতেই চাননি।
এবার আসা যাক তৃণমূল প্রসঙ্গে। টানা দশ বছর ক্ষমতায় থাকলে স্বাভাবিক কারণেই প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার একটা হাওয়া দেখা যায়। সেটা যে রয়েছে, ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনেই তার প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে। এবারও ছিল। এ ছাড়া তৃণমূলের বিরুদ্ধে ছিল আগাপাশতলা দুর্নীতির অভিযোগ। আবার বিভিন্ন ক্ষেত্রে রাজ্য সরকারের ব্যর্থতারও বহু অভিযোগ ছিল। অভিযোগ ছিল গ্রামগঞ্জে ক্রমবর্ধমান হিংসারও।
এমনকী, তৃণমূলকে জয়ের পথে নিয়ে যেতে দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ব্যক্তিগত ক্যারিশমাও কতখানি কাজ করবে, তা নিয়েও বিভিন্ন মহলে প্রশ্ন বা সংশয় দেখা দিতে শুরু করেছিল।
তবুও এবারের নির্বাচনে তৃণমূলের ব্যাপক জয় এসেছে। আর সেই জয় নিয়ে সংশয়ের কোনও অবকাশ নেই।
আর এই অবস্থাতেই তৃণমূলকে পরামর্শ দিতে আসেন প্রশান্ত কিশোর। তাঁর পরিচয় নির্বাচনকুশলী। মানে, বাংলায় তিনি এবং তাঁর সংস্থা ‘আইপ্যাক’ তৃণমূলের রাজনৈতিক পরামর্শদাতা।
আমি মনে করি, তৃণমূলের এই বিপুল জয়ের নেপথ্যে প্রধান কারিগর তিনিই। এর আগেই অবশ্য রাজনৈতিক পরামর্শদাতা হিসেবে তিনি সাফল্য দেখিয়েছেন বিজেপি, কংগ্রেস এবং আম আদমি পার্টির হয়ে কাজ করে।
যতদূর শুনেছি, তাঁকে এই রাজ্যে নিয়ে আসেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। তার পর মুখোমুখি বৈঠক হয় তাঁদের দু’জনের সঙ্গে মমতার। তখনই চূড়ান্ত হয় এই রাজ্যে তাঁকে দায়িত্ব দেওয়ার বিষয়টি।
তবে এখানে কাজ করতে গিয়ে তাঁকে কম সমস্যায় পড়তে হয়নি! তৃণমূলের অভ্যন্তরেই বহু নেতা ও নেত্রীর ক্ষোভের মুখে বারবার পড়তে হয়েছে তাঁকে। তবু তিনি নিজের কাজ করে গিয়েছেন।
তার পরই আমরা দেখতে পেলাম বাংলায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সরকারের এক–একটা মাস্টার স্ট্রোক। দিদিকে বলো, দুয়ারে সরকার, বাংলার গর্ব মমতা, বাংলা তার মেয়েকেই চায়, স্বাস্থ্যসাথী প্রকল্প, বার্ধক্য ভাতা, বিধবা ভাতা প্রভৃতি।
একটা জাতিকে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে এই প্রকল্পগুলির সত্যিই কোনও গুরুত্ব আছে কিনা বা তাতে জাতির সম্মান বাড়ে কিনা, তা নিয়ে প্রশ্ন থাকতেই পারে। কিন্তু রাজ্যের সাধারণ মানুষ কিন্তু এই প্রকল্পগুলি খুবই আগ্রহের সঙ্গে গ্রহণ করেছেন।
অবশ্য প্রকল্পগুলি নিয়ে প্রশ্ন একেবারেই যে ওঠেনি, তা নয়। অনেকেই বলেছেন, দশ বছর পর এই প্রকল্পগুলি যদি কোনও সরকারের নেওয়ার প্রয়োজন হয়, তা হলে ফেলে আসা দশ বছর সরকার করলটা কী?
তবে, মানুষ কিন্তু এত তলিয়ে ভাবেননি। তাই প্রকল্পগুলির সুফল গিয়েছে তৃণমূলের পক্ষেই। বলা বাহুল্য, এই পদক্ষেপগুলি ছিল প্রশান্ত কিশোরেরই মস্তিষ্কপ্রসূত।
তা ছাড়া নির্বাচন শুরু হওয়ার আগেই প্রশান্ত কিশোর বলেছিলেন, বিজেপির আসন সংখ্যা দুই অঙ্ক পেরোবে না। পেরোলে তিনি পরামর্শদাতার কাজ ছেড়ে দেবেন। ফল কিন্তু তাই হয়েছে।
সেই কারণে তৃণমূলের সাফল্যের পেছনে আজ তাঁর ভাবনাচিন্তা ও পরিকল্পনার তাৎপর্য স্বীকার করে নিতে হবে।
কিন্তু, আবার এ কথাও সত্য, প্রশান্ত কিশোরের এই সাফল্য ভারতের মতো গণতান্ত্রিক দেশে ভোটে জেতার জন্য রাজনৈতিক দলগুলির কাছে একটা ভিন্ন উপায় তৈরি করে দেওয়ার প্রক্রিয়াকে আরও সক্রিয় করবে। কেন না, প্রশান্ত কিশোর এবং তাঁর সংস্থার সাফল্য এই ধরনের আরও অনেক সংস্থা তৈরি হওয়ার পথ খুলে দিতে পারে।
সে ক্ষেত্রে যে কোনও রাজ্যেই শাসক দল ব্যর্থ হলেও বা জনবিরোধী কাজ করলেও ভোটের আগে নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়ার জন্য এই ধরনের সংস্থাগুলির দ্বারস্থ হবে। আর, সে ভাবেই জেতার পথ খোঁজার চেষ্টা করবে। তাতে ভোট দেওয়া নিয়ে সাধারণ মানুষের স্বাধীন ভাবনাচিন্তা করার পথ রুদ্ধ হয়ে যেতে পারে।
সোজা কথায়, সাধারণ মানুষের সমর্থন পাওয়া নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে কোনও ভীতিই আর থাকবে না। মানুষের মতামতকে সে ভাবে গুরুত্ব দেওয়ার প্রয়োজন বোধও করবে না তারা। যদিও বাংলার এই নির্বাচনের পর প্রশান্ত কিশোর ঘোষণা করেছেন, তিনি আর পরামর্শদাতার কাজ করবেন না।
তবে তাঁর সংস্থা আইপ্যাক বন্ধ করে দেওয়ার কথা কিন্তু তিনি বলেননি। বরং সংস্থাটি আগের মতোই কাজ করে যাবে বলে জানিয়েছেন। তার মানে এই রীতির অবসান কিন্তু হচ্ছে না। তা ছাড়া, তিনি ইতিমধ্যে পঞ্জাবেও ভোটকুশলীর দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন বলে শোনা যাচ্ছে।
যাই হোক, নন্দীগ্রামে বিজেপি প্রার্থী শুভেন্দু অধিকারীর কাছে নিজে হারলেও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দলের এই সাফল্যের পেছনে প্রশান্ত কিশোরের ভূমিকার কথা কোনও মতেই অস্বীকার করা যাবে না। বিশেষ করে জনমুখী প্রকল্পগুলি রাজ্যের মানুষ যে গ্রহণ করবেন, তা তিনি আগেই বুঝে গিয়েছিলেন।
এ কথা সত্য, আগে থেকেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নানা ধরনের জনমুখী নীতি গ্রহণ করে আসছেন। তাতে রাজ্যের অর্থনীতির ওপর বিপুল চাপ তৈরি হলেও তাকে গুরুত্ব দেননি। ভোটে তারও ছবি শুধু এবার নয়, এর আগেও দেখা গিয়েছে।
এ ছাড়া এবার তৃণমূলকে ঢেলে ভোট দিয়েছেন মহিলারাও। বিশেষ করে মহিলাদের ব্যাঙ্কে ৫০০ টাকা করে জমা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি, বিধবা ভাতা, বার্ধক্য ভাতা প্রভৃতি পদক্ষেপগুলি তারা দারুণ ভাবে গ্রহণ করেছে। আবার যুবশ্রী থেকে মারা গেলে টাকা দেওয়ার প্রতিশ্রুতিও রাজ্যের অভাবী মানুষকে তার দিকে টেনে নিয়ে গিয়েছে।
পাশাপাশি কমিউনিস্ট এবং কংগ্রেস সমর্থকদের অধিকাংশের ভোটই এবার গিয়েছে তৃণমূলের ঝুলিতে। লোকসভা নির্বাচনে এই ভোট গিয়েছিল বিজেপিতে। কিন্তু এবার বিভিন্ন মহলের তরফে বিজেপিকে রোখার একটা প্রশ্ন তুলে দেওয়া হয়েছিল।
সে ক্ষেত্রে ‘কম খারাপ, বেশি খারাপ’ তত্ত্ব তৈরি করেছিলেন অনেক কমিউনিস্ট নেতা। তাই অনেক কমিউনিস্ট মনোভাবাপন্ন মানুষ তৃণমূলকে বিজেপির তুলনায় ভালো বলে গ্রহণ করেছেন। সেই কারণে নিজের ভোটটাও তাঁরা নিজেদের দলকে দিয়ে নষ্ট করতে চাননি।
এবার আসি মুসলিমদের কথায়। তাঁরা এবারও ধর্মীয় মেরুকরণকেই গুরুত্ব দিয়েছেন। মনে রাখতে হবে, সংখ্যালঘুরা যাতে বিজেপিকে ভোট না দেন, তাঁরা যেন তৃণমূলকে ভোট দেন, ভোট প্রচারে গিয়ে এমন কথা বলেছিলেন স্বয়ং মমতাই। ধর্মের ভিত্তিতে ভোট চাওয়ায় নির্বাচন কমিশন পর্যন্ত তাঁকে শো–কজ করেছিল।
যাই হোক, প্রত্যাশা মতোই মুসলিমরা এবারও বিজেপিকে রুখতে তৃণমূলকে ভোট দিয়েছেন। এমনকী, আব্বাস সিদ্দিকীর আইএসএফ–কেও তাঁরা সে ভাবে ভোট দেননি। কয়েকটি আসনে আসাদউদ্দিন ওয়াইসির ‘মিম’ প্রার্থী দিয়েছে। মুসলিমরা তাদের দিকেও সমর্থনের হাত বাড়িয়ে দেননি।
সব মিলিয়ে এবারের ভোট তৃণমূলের পক্ষে ইতিবাচকই হয়েছে। কিন্তু প্রশান্ত কিশোর যদি বাংলায় না আসতেন, দশ বছর বাংলা শাসন করার পর প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার কাঁটা বিছানো পথ এমন সাফল্যের সঙ্গে তৃণমূল অতিক্রম করতে পারত কিনা, সে বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে।
তাই পশ্চিমবাংলার এই বিধানসভা নির্বাচনে সবচেয়ে আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব কিন্তু প্রশান্ত কিশোরই।